মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

১১ বছরে অবৈধ আয়ে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তা


বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর পরিদর্শক সৌরভ কুমার সাহা ১১ বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ। লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন ঘুষ বাণিজ্য থেকে মাসে আয় করতেন ৩০-৩৫ লাখ টাকা। এ টাকায় কিনেছেন বাস, প্রাইভেট কার ও সিএনজি। ঘুষ কেলেঙ্কারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করলেও তিনি জামিনে মুক্ত।

১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৫:০৯ অপরাহ্ণ 

১১ বছরে অবৈধ আয়ে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তা
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সৌরভ কুমার সাহা। বিআরটিএ নোয়াখালী কার্যালয়ে চাকরিজীবন শুরু করেই বদলে যায় তার ভাগ্য। এর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। মাত্র ১১ বছরের চাকরি জীবনে অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে তিনি নামে-বেনামে গড়েছেন অর্ধশত কোটি টাকার বিপুল সম্পদ।

ফরিদপুর সদর উপজেলার সাধারণ পরিবারে জন্ম সৌরভের। তার বাবা ছিলেন পত্রিকার হকার। সংসার চলত টানাটানির মধ্য দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনর সুপারিশে ২০১৪ সালে বিআরটিএ অফিসে চাকরি পান সৌরভ। এরপর মাত্র এক দশকেই তিনি বাবা, শ্বশুর, শ্যালকসহ আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে গড়েছেন অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ।

কিনেছেন ১০টি বাস, চারটি প্রাইভেট কার ও অসংখ্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ফরিদপুরে এসব যানবাহন তত্ত্বাবধান করেন তার ভগ্নিপতি। নিজের জন্য কিনেছেন অর্ধকোটি টাকার বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি।

দ্রুত পদোন্নতি ও ঘুষ বাণিজ্য

আওয়ামী পরিবারের সন্তান হওয়ায় চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর দ্রুত পদোন্নতি পান সৌরভ। মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে বিআরটিএ পরিদর্শক হন। চাকরি করেছেন ঢাকার উত্তরা, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায়। ২০২৩ সালের শুরুতে বদলি হয়ে বরিশালে যোগ দেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার ঘুষ বাণিজ্যের বিস্তার।

ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন এই তিন খাত থেকেই প্রতি মাসে অবৈধ আয় করেন ৩০-৩৫ লাখ টাকা। প্রতি বোর্ডে লাইসেন্স পরীক্ষায় হাতেগোনা কয়েকজনকে পাস করানো হয়। পরে বিআরটিএর চিহ্নিত দালাল ও সৌরভের ড্রাইভার রিয়াজ খান, আলাউদ্দীন, জাকির, আসাদুল, হৃদয়সহ ২০-২৫ জন ফেল করা পরীক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা আদায় করে। লাইসেন্সপ্রতি আড়াই হাজার টাকা পায় সৌরভ। বাকি টাকা দালালদের।

ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত না থাকলে সৌরভ সহজে নিজের তালিকায় সই করিয়ে পাস করিয়ে দেন পরীক্ষার্থীদের। এভাবেই প্রতি বোর্ডে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা এবং মাসে ৩০-৩৫ লাখ টাকা অবৈধ আয় করেন তিনি।

রেজিস্ট্রেশনেও ঘুষের ছড়াছড়ি

সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রতি ফাইলে ৪০-৫০ হাজার টাকা, ট্রাকের জন্য ৫-১০ হাজার এবং মোটরসাইকেলের জন্য ১-১.৫ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সৌরভের বিরুদ্ধে। ফিটনেস থেকেও আদায় করতেন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

গত বছর অনুমোদনের আগেই ১৯১টি সিএনজির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে প্রতিটি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন তিনি। বিষয়টি ফাঁস হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তা রাজকুমার সাহা বাদী হয়ে সৌরভকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। মামলায় বিআরটিএর সহকারী পরিচালক রোকনুজ্জামান ও রানার অটো-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। মামলা হলেও সৌরভ রহস্যজনকভাবে জামিন পান।

বিলাসবহুল জীবন ও পরিবহন ব্যবসা

বর্তমানে বরিশালের নতুনবাজার এলাকায় ২৭ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন সৌরভ। দামি প্রাইভেট কারে অফিসে যাতায়াত করেন। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাবার নামে হলেও যোগাযোগ নম্বর সৌরভের। তার নামে বা আত্মীয়স্বজনের নামে আছে ‘হাওলাদার পরিবহন’সহ একাধিক পরিবহন ব্যবসা।

‘হাওলাদার পরিবহন’-এর ব্যানার কিনে নিয়েছেন তিনি, যদিও কাগজে সেটি বাবা ও শ্বশুরের নামে। বর্তমানে তার ১০টি বাস বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে—ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও গোপালগঞ্জ রুটে।

বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, সৌরভ তার ড্রাইভার রিয়াজ খানের মাধ্যমে ঘুষের টাকা সংগ্রহ ও গাড়ির কিস্তি পরিশোধ করেন। বরিশাল ইফাদ মোটরস থেকে কিস্তিতে তিনটি গাড়ি কেনা হয়েছে, যেগুলোর রেজিস্ট্রেশন কোম্পানির নামে।

মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম ধরা

২৯ সেপ্টেম্বর মাঠ পরীক্ষায় উপস্থিত থেকে দেখা যায়, মোটরসাইকেল পরীক্ষায় ৬১ জন অংশ নিলেও পাস করানো হয় মাত্র তিনজনকে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন না। একাই পরীক্ষা নেন সৌরভ সাহা ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টর কেএম রহমান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ হেল মাফি জানান, ব্যস্ততার কারণে তিনি দেরিতে আসেন এবং যোগ্যদের পাস করিয়েছেন।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিপুল সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সৌরভ কুমার সাহা দাবি করেন, তার বাবার নামে মাত্র একটি বাস রয়েছে, যা ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির অধীনে চলে। এছাড়া তিনি রেন্ট-এ-কার ব্যবসায় জড়িত নন বলে দাবি করেন। হাওলাদার ও আশিক পরিবহনে বাস থাকার কথাও অস্বীকার করেন তিনি। আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদ গড়ার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেন।

তবে সূত্র বলছে, বিগত এক দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অঢেল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন সৌরভ। আত্মীয়-স্বজন ও দালাল চক্রকে ব্যবহার করে তিনি এখন বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত এক বিত্তশালী কর্মকর্তা।