শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

দুর্বল রোড সেফটি কাঠামো নিয়ে চলছে নিরাপদ সড়ক দিবসের আয়োজন


আজ সারা দেশে পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’, যার লক্ষ্য সড়ক দুর্ঘটনা কমানো ও সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে মোটরসাইকেল আরোহীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রয়োগ ও প্রশিক্ষণ জোরদার না হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।

২২ অক্টোবর ২০২৫, ৩:০৯ অপরাহ্ণ 

দুর্বল রোড সেফটি কাঠামো নিয়ে চলছে নিরাপদ সড়ক দিবসের আয়োজন
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

আজ সারাদেশে নবম বারের মতো পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। প্রতি বছরের মতো এবারও সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা।

সড়কে যখন দিন দিন দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি বাড়ছে, তখন এই দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মোটরসাইকেল: বড় ঝুঁকিপূর্ণ যান ও তরুণদের মৃত্যুফাঁদ

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মোটরসাইকেল এখন বড় ঝুঁকির যানে পরিণত হয়েছে। গত এক দশকে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ, আর একই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার।

ভয়াবহ পরিসংখ্যান:

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ১৩ মাসের (জুলাই ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫) তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩২.১৪ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ৫ বছরের (২০২০-২০২৪) তথ্যে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় মোট প্রাণহানির ৩৫.৬৭ শতাংশ মোটরসাইকেল আরোহী।
বিআরটিএর তথ্যমতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
চালকদের অনিয়ম: বিআরটিএ জানাচ্ছে, নিহত মোটরসাইকেল চালকদের ৮০ শতাংশের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই এবং অধিকাংশ চালক, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে হেলমেট ব্যবহার করেন না।
শিশুদেরও ঝুঁকি: রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪ হাজার ৮০৬ শিশুর মধ্যে ১ হাজার ৫৮৫ জনই ছিল মোটরসাইকেলের আরোহী, যা নিহত শিশুদের প্রায় ৩৩ শতাংশ।

পঙ্গু হাসপাতাল: মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার আহতদের ভিড়

সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় অন্যতম বড় ভরসা রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)। নিটোরের তথ্যমতে, জুন ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫—এই এক বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ২২ হাজার ৬৪৫ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সংখ্যা ৮ হাজার ১৫০। আহতদের বড় অংশই জীবনভর পঙ্গুত্ব বা বিকলাঙ্গতা নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছেন।

উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ২১ স্থান: দুর্ঘটনার ১৪% এখানেই

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে ৩০ হাজার ৭৭৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ হাজার ২৪৬ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৫১ হাজার মানুষ। গবেষণায় সারা দেশে ৩৭ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে ২১টি স্থানকে সড়ক দুর্ঘটনার অতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ২১টি স্থানে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও ধামরাই, গাজীপুরের সদর, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, বগুড়ার শেরপুর এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই, পটিয়া ও সীতাকুণ্ডসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে গত পাঁচ বছরে ৪ হাজার ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ মতামত ও সমাধানের পথ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, বিশ্বব্যাপী মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সাধারণ যানবাহনের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের মতো বিশৃঙ্খল পরিবেশে এই ঝুঁকি আরও বেশি।

নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা অন্যতম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পাথওয়ে–এর নির্বাহী পরিচালক মো. শাহিন বলেন, “শুধু একটি দিন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সড়ক-মহাসড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগ।”

তিনি আরও বলেন, রোড সেফটির জন্য বিআরটিএ-এর ‘রোড সেফটি ডিপার্টমেন্ট’ থাকলেও এর কার্যক্ষমতা খুবই সীমিত। মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের আরও সচেতন হতে হবে এবং পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশকে সমন্বিতভাবে মাঠে কাজ করতে হবে। সড়কে বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম আরও জোরদার করা জরুরি।

রোড পারমিট ও ফিটনেস সনদ প্রদানে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সারা দেশে চোখে দেখে গাড়ির ফিটনেস দেওয়া হয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শুধুমাত্র বিআরটিএ মেট্রো সার্কেল-১-এ একটি ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার রয়েছে।

উন্নত দেশগুলোতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে অনুমোদিত ড্রাইভিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদন প্রক্রিয়ায় কোনো অনুমোদিত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের শর্ত না থাকায় সাধারণ কম্পিউটার দোকান থেকেই আবেদন করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিটে পরীক্ষা শেষ করে লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই অদক্ষ অবস্থায় সড়কে নামছেন—যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

তিনি আরও জানান, সারা দেশে নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুলের সংখ্যা ১২৩টির মতো হলেও বিআরটিএ এর কার্যক্রম তদারকিতে তেমন ভূমিকা রাখছে না। ফলে নিবন্ধনহীন অসংখ্য টং দোকানের মতো ড্রাইভিং স্কুল গড়ে উঠেছে। এতে করে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো মান বজায় রাখতে পারছে না।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “বিআরটিএ যদি নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুলগুলোকে নীতিমালার আওতায় এনে নিয়মিত তদারকি করে এবং নিবন্ধনহীন স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়, তবে সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব।”


দিবসটির প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে, সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে দ্রুত নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষত, মোটরসাইকেল চালকদের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ, মানসম্মত হেলমেট নিশ্চিত করা এবং গতি নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।